ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যেখানে মানবতার মর্যাদা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়। সমাজে নিপীড়িত, অসহায় ও বন্দীদের প্রতি ইসলামের রয়েছে এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি। বিশেষ করে মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করা ইসলামে শুধু সদাকার একটি শ্রেষ্ঠ রূপ নয়, বরং এটি একটি ওয়াজিব বা আবশ্যকীয় দায়িত্ব।
বন্দী মুক্তি: কুরআন ও হাদীসের আলোকে
রাসূলুল্লাহ ﷺ স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন:
“فُكُّوا العَانِيَ، يَعْنِي: الأَسِيرَ، وَأَطْعِمُوا الجَائِعَ، وَعُودُوا المَرِيضَ”
(সহিহ বুখারী, হাদীস: ৩০৪৬)অর্থ: “তোমরা বন্দীকে মুক্ত করো, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও এবং রোগীকে দেখতে যাও।”
এই হাদীসের মাধ্যমে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের প্রতি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যার প্রথমটি হলো—বন্দী মুক্ত করা। এটি প্রমাণ করে যে ইসলাম একজন বন্দীর অবস্থা কতটা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস আলী (রাঃ)-এর সূত্রে পাওয়া যায়:
“العقل وفكّاك الأسير وأن لا يُقتل مسلم بكافر”
(সহিহ বুখারী, হাদীস: ৩০৪৭)অর্থ: “(তাতে আছে) দিয়তের বিধান, বন্দী মুক্তি করা এবং কোনো মুসলিমকে কাফিরের বিনিময়ে হত্যা না করা।”
ইসলামী ফিকহবিদদের মতামত
ইসলামের বিদ্বান ও ফিকহবিদরাও এই বিষয়ে একমত যে মুসলিম বন্দী মুক্ত করা একটি ওয়াজিব কাজ। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) তাঁর বিখ্যাত হাদীস ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’-তে বলেন:
“فكاك الأسير واجب على الكفاية، وبه قال الجمهور”
(ফাতহুল বারী: ৬/১৯৩)অর্থ: “বন্দী মুক্ত করা মুসলমানদের উপর ওয়াজিবে কিফায়া। এ বিষয়ে অধিকাংশ আলিম একমত।”
অর্থাৎ, যদি কিছু মুসলিম এই দায়িত্ব পালন করে, তাহলে অন্যদের দায়িত্ব কাঁধ থেকে সরে যায়। কিন্তু কেউই না করলে, পুরো মুসলিম সমাজ গুনাহগার হবে।
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেন:
“فكّاك الأسارى من أعظم الواجبات، وبذل المال الموقوف وغيره في ذلك من أعظم القربات”
(মাজমু’ ফাতাওয়া: ২৮/৬৩৬)অর্থ: “বন্দী মুক্ত করা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব, এবং এতে ওয়াকফ সম্পদ ও অন্যান্য সম্পদ ব্যয় করাও আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়।”
ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন:
“فداء الأسرى واجب وإن لم يبق درهم واحد”
(তাফসীর কুরতুবী: ২/২৪)অর্থ: “বন্দী মুক্তিপণ দেওয়া ওয়াজিব, এমনকি তাতে একটি দিরহামও অবশিষ্ট না থাকে।”
সমসাময়িক বাস্তবতা ও আমাদের করণীয়
বর্তমানে বহু মুসলিম ভাই অন্যায়ভাবে বা আর্থিক অক্ষমতার কারণে জেলখানায় বন্দী হয়ে আছেন। তাদের অধিকাংশই মামলার খরচ বহনে অক্ষম। অনেক সংগঠন ও প্রকল্প আছে যারা এই ভাইদের মুক্তির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের অভিজ্ঞতা বলছে—বহু মামলার অগ্রগতি থেমে গেছে শুধুমাত্র অর্থের অভাবে।
এই বাস্তবতায় আমাদের উচিত, এই দায়িত্বকে একটি ওয়াজিব হিসেবে গ্রহণ করা। সাধারণ সদাকা, যাকাত, মান্নত কিংবা ফিদইয়া—যেকোনো হালাল দান-খয়রাতের মাধ্যমে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতে অংশগ্রহণ করা। এটি যেন শুধু একজন মানুষের মুক্তিই নয়, বরং পুরো সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, মানবিকতার পুনরুদ্ধার এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি উপায়।
উপসংহার
উপরোক্ত কুরআন-হাদীস ও আলিমদের বক্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট যে মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করা শুধু সহানুভূতির বিষয় নয়, বরং এটি একটি শরঈ দায়িত্ব। তাই আসুন, আমরা এই পুণ্যময় দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসি—নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী দান করে, কথা বলে, প্রচার করে এবং সর্বোপরি—একটি সচেতন উম্মাহ হিসেবে এই দায়িত্ব কাঁধে নিই।