মানবজীবনের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনের উদ্দেশ্য নির্ধারণে যে চিন্তার সর্বোচ্চ স্তম্ভ হতে পারে, তা হলো তাওহিদ বা একত্ববাদের বিশ্বাস। তাওহিদ কেবল আল্লাহর একত্বের ঘোষণায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন। একটি তাওহিদি প্রজন্ম মানে এমন এক তরুণ সমাজ, যারা চিন্তা, চেতনা, নৈতিকতা ও কর্মে আল্লাহর সর্বময় কর্তৃত্বকে গ্রহণ করে এবং তাঁর দেওয়া বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করে। এই প্রজন্মের চিন্তার গঠন এবং বিনির্মাণ একটি জরুরি ও সময়োপযোগী প্রয়াস—বিশেষত এমন এক যুগে, যখন ভোগবাদ, বস্তুবাদ ও নৈতিক অধঃপতন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
তাওহিদি চেতনার ভিত্তি
তাওহিদি চিন্তার মূলে রয়েছে আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য, রাসূল (সা.)-এর অনুসরণ, এবং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এটি এমন এক জীবনদর্শন, যা মানুষকে কেবল আত্মকেন্দ্রিকতা ও উপকরণভিত্তিক লাভালাভ থেকে মুক্ত করে, তাকে একটি বৃহৎ কল্যাণকামী দৃষ্টিভঙ্গিতে উদ্বুদ্ধ করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি যেমন ব্যক্তিগত চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখে, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেও পরিবর্তনের বীজ বপন করে।
বর্তমান প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ
আজকের তরুণ সমাজ একদিকে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি, অপরদিকে তথ্যের অতিবাহুল্য ও বিভ্রান্তির মাঝে অবস্থান করছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও নব্য উপনিবেশিক চিন্তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এমনভাবে প্রবেশ করেছে যে, অনেক মুসলিম তরুণ নিজের পরিচয় নিয়েই দ্বিধায় ভোগে। ধর্মকে কেবল ব্যক্তিগত একটি বিষয় মনে করা হচ্ছে, এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে আল্লাহর বিধানকে সচেতনভাবে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে তাওহিদি চিন্তাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা এবং এর ভিত্তিতে একটি প্রজন্ম গঠনের চেষ্টাই হতে পারে ভবিষ্যতের জন্য প্রকৃত মুক্তির পথ।
বিনির্মাণের ধাপসমূহ
১. চিন্তার স্বচ্ছতা
তাওহিদি প্রজন্ম গঠনের প্রথম ধাপ হলো তাওহিদের প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য তরুণদের মাঝে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। এটি কেবল ‘আল্লাহ’র একত্ব স্বীকার করার নাম নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে—ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনে—আল্লাহর বিধানকে প্রাধান্য দেওয়া।
২. জ্ঞানচর্চা
শরয়ি জ্ঞান এবং ফিকহুল ওয়াক্বি (সমকালীন বাস্তবতা-ভিত্তিক জ্ঞান) এই দুইয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে এমন চিন্তাশীল মানুষ তৈরি করতে হবে, যারা একদিকে কুরআন-সুন্নাহর গভীরতা অনুধাবন করে, অন্যদিকে সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতির সমসাময়িক জটিলতাও বুঝতে সক্ষম।
৩. মক্তব শিক্ষা
একটি সুদৃঢ় তাওহিদি প্রজন্ম গঠনের জন্য প্রাথমিক স্তর থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। মক্তব শিক্ষা হলো সেই ভিত্তি, যেখানে শিশুরা কুরআন, আকীদাহ ও নৈতিকতা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পায়। তাই মক্তবকে হতে হবে যুগোপযোগী, চিন্তাশীল এবং আদর্শিক প্রেরণায় সমৃদ্ধ। সাদাকাহ প্রজেক্ট কর্তৃক পরিচালিত মক্তব শিক্ষা এই প্রজন্মের একটি মাইলফলক হবে ইনশাআল্লাহ।
৪. আদর্শিক শিক্ষা
শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে তাওহিদি মূল্যবোধ সংযোজন করা অপরিহার্য। আমাদের মাদরাসা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে তাওহিদভিত্তিক নৈতিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে কোনো মুসলিম নব্য জাহিলিয়াহ তথা সেক্যুলার বা তথাকথিত মডারেট না হয়ে ওঠে।
৫. মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল
মিডিয়াকে ব্যবহার করে তাওহিদি চেতনা ছড়িয়ে দিতে হবে। হলুদ মিডিয়ার বিভ্রান্তির জাল ছিন্ন করে ন্যায়ের বানী ও ইনসাফের আহ্বান পৌঁছে দিতে হবে প্রতিটি জনপদের সর্বসাধারণের কর্ণকুহরে। এভাবেই গড়ে উঠবে একটি চিন্তাশীল সংস্কৃতি।
৬. সেমিনার ও স্ট্রিট দাওয়াহ
তরুণদের মাঝে সরাসরি আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে সেমিনার, আলোচনা সভা ও আল-কুরআনের দারসের আয়োজন করতে হবে। পাশাপাশি স্ট্রিট দাওয়াহের মাধ্যমে জনসাধারণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে তাওহিদি বার্তা পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে।
৭. তরুণদের সক্রিয়তা
শুধু বই পড়ে নয়, বাস্তব জীবনে তরুণদের তাওহিদি মূল্যবোধ অনুযায়ী কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে—চিন্তায়, কর্মকাণ্ডে ও সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসেবে।
তাওহিদি প্রজন্ম গঠন মানে কেবল একটি ইসলামি সমাজ নয়, বরং একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও সত্যনিষ্ঠ সমাজ গঠন। এই প্রজন্ম হবে এমন, যারা আল্লাহর সামনে দায়বদ্ধ, সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল এবং সত্যের পথে দৃঢ়। নববী মানহাজে তাঁরা আপোষহীন। জিহাদ ফি-সাবিলিল্লাহ’র অগ্রসৈনিক।
তাওহিদের আলোয় আলোকিত একটি প্রজন্মই পারে এই নৈরাজ্যময় ও বৈষম্যময় দুনিয়ায় শান্তির আলো ছড়িয়ে দিতে। তাই, চিন্তার এই বিপ্লব—তাওহিদি চিন্তার বিপ্লব—হোক আমাদের আগামী দিনের মূল কৌশল ও সংগ্রামের পথনির্দেশক।